বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ডNo nation can prosper without knowledge (শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না) কথাগুলোর মধ্যে গভীর রহস্য লুকিয়ে আছেযদি কোনো জাতি শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে থাকে তাহলে সেই জাতির দ্বারা উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌছানো কখনোই সম্ভব নয়নেপোলিয়ান বলেছিলেনতোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো


একটা কথা প্রচলিত আছে যে, শিক্ষার জন্য যদি সূদুর চীন দেশে যেতে হয়, তারপরও তোমরা সেখানে যাও এবং শিক্ষা গ্রহণ করোবিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আলোকে আমাদের দেশেও শিক্ষা বিভাগসমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে আর আজকে আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাসমূহ


বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থাসমূহকে প্রাথমিকভাবে তিনভাগে ভাগ করা যায় জেনারেল শিক্ষা বিভাগ, মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগ নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

 

. জেনারেল শিক্ষা 

প্রাথমিকভাবে আমরা বাংলাদেশে জেনারেল শিক্ষা বলতে আমরা বাংলা, গণিত, ইংরেজি, সমাজ, ভূগল, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় বুঝে থাকি, তবে জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমরা চার স্তরে ভাগ করতে পারি

 ·    সাধারণ শিক্ষা বা মানবিক বিভাগ : এই বিভাগের মধ্যে রয়েছে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, সমাজ, ভূগল, ইতিহাস, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ ইত্যাদি বিষয়এছাড়াও সাধারণ বিজ্ঞান পড়ানো হয়

 ·    বিজ্ঞান বিভাগ : এই বিভাগের মধ্যে রয়েছে পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিতের মতো কিছু জটিল সাবজেক্ট তবে এখানে বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়ও পড়ানো হয়

 ·    কমার্স বা ব্যবসায় বিভাগ : যেসকল ছাত্র/ছাত্রীরা উদ্যোক্তা, ব্যংক বা ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছে লালনপালন করে থাকে তারা হিসাব বিজ্ঞান, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনা, এবং মার্কেটিং এর মতো কিছু বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে থাকে। মানবিক এবং বিজ্ঞান বিভাগের মতো এখানেও বাংলা এবং ইংরেজি পড়ানো হয়ে থাকে।

 · ইংলিশ মিডিয়াম : বাংলাদেশে আরো একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে আর তা হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম যেখানে ছাত্র/ছাত্রীরা শুধু ইংরেজি ভাষাতে পড়াশোনা করে থাকে মানে হচ্ছে তাদের সব বিষয়ই ইংরেজিতে পড়তে হয়এখানে ক্লাসের স্তরগুলো হচ্ছে  স্ট্যান্ডার্ড ওয়ান থেকে স্ট্যান্ডার্ড  নাইন, তারপর ও (O) লেভেল যেটাকে আমরা মাধ্যমিক এবং (A) লেভেল যেটাকে আমরা উচ্চমাধ্যমিক বলে থাকি

 

জেনারেল বিভাগের ক্লাসের স্তরসমুহ : আমাদের দেশে বর্তমানে ক্লাস শুরু হচ্ছে শিশুশ্রেণি থেকেইতারপর ক্রমান্বয়ে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ, অনার্স এবং মাস্টার্স পর্যন্ত


পরীক্ষা পদ্ধতি  : বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিটি শ্রেণি পর্যায়েই ক্লাস পরীক্ষা হয়। যেমন, মডেল টেস্ট, ইনকোর্স, মিডটার্ম, প্রথম সেমিস্টার, দ্বিতীয় সেমিস্টার, এবং বার্ষিক পরীক্ষা। এছাড়াও দশম শ্রেণির পরে হয় এস এস সি (SSC), দ্বাদশ বা ইন্টারে হয় এইচ এস সি (HSC) বোর্ড পরীক্ষা (বোর্ড পরীক্ষা বলতে যে পরীক্ষায় বাংলাদেশের সকল ছাত্র/ছাত্রী অংশগ্রহণ করে থাকে বা সরকারি ভাবে যে পরীক্ষা নেওয়া হয়)। 

 

শিক্ষাবোর্ড : বাংলাদেশে মোট ৯টি শিক্ষাবোর্ড রয়েছে। যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে জেলা ভিত্তিক যেমন, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর।

এছাড়াও মাদরাসা এবং কারিগরি শিক্ষাবোর্ড রয়েছে।\

 

. মাদরাসা শিক্ষা

আমাদের দেশে বর্তমানে মাদরাসার ছাত্র/ছাত্রীরা ভালো অবস্থানে রয়েছে তারা আরবির পাশাপাশি জেনারেল বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে রপ্ত করে নিয়েছে যার দরুণ তারা মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অনায়াসে চান্স পাচ্ছেমাদরাসা শিক্ষাকে আমরা তিন স্তরে ভাগ করতে পারি

 ·    আলিয়া মাদরাসা : আলিয়া মাদরাসাগুলো অনেকটা জেনারেল এর মতোই এখানে অতিরিক্ত শুধু আরবি বিষয় পড়ানো হয় ছাত্ররা আরবির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, এবং গণিতের মতো বিষয়গুলো পড়েএছাড়া মাদরাসাতেও মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগ আছেআলিয়ার ক্লাসের স্তরগুলো হচ্ছে শিশু থেকে নাইন, তারপর দাখিল (যেটাকে আমরা এস এস সি বলি), আলিম (যেটাকে আমরা এইচ এস সি বলি), ফাযিল (যেটাকে আমরা ডিগ্রি বলি), কামিল (যেটাকে আমরা মাস্টার্স বলি)

 ·      ক্বওমী মাদরাসা : যেসকল শিক্ষার্থীরা বড় আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির হতে চায় তারাই শুধুমাত্র ক্বওমী মাদরাসাতে পড়াশোনা করে এখানে বড় বড় আরবি কিতাব পড়ানো হয় যেমন, বুখারী, মুসলীম, তিরমিযি, নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ সহ আরো অনেক প্রসিদ্ধ হাদীসের কিতাব। ক্বওমী মাদরাসার ক্লাস স্তরগুলো হচ্ছে  মুতাওয়াসসিতাহ- নিম্ন মাধ্যমিক-১, মুতাওয়াসসিতাহ- নিম্ন মাধ্যমিক-২, মিযান, নাহবেমীর, হেদায়াতুন্নাহু, কাফিয়া, শরহে জামি, শরহে বেকায়া, জালালাইন, মিশকাত, দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পর্যন্ত।  

 ·         দ্বীনিয়া মাদরাসা: বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে দ্বীনিয়া মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড একটি অন্যতম এটা অনেকটা কওমি মাদ্রাসার মতই, তবে তাদের সিলেবাস বা ক্লাসের স্তরটা একটু ভিন্ন খ্যাতিমান আলেম ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে এটি ২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫ অক্টোবর দ্বীনিয়া মাদরাসা নিজেদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে দ্বীনিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে। নিম্নে আলোচনা করা হলো :-

 ·  প্রথম পর্যায় : এ পর্যায়ে রয়েছে ২টি স্তর।

প্রথম স্তর : রয়েছে সাধারণ শিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষা। এখানে পড়ানো হয় বাংলা, ইংরেজি, সমাজ বিজ্ঞান, গণিত ও ইসলামিয়াত। এ স্তরকে পঞ্চম শ্রেণির মান ধরা হয়। এটাকে বলা হয় আল মারহালাতুল ইবতিদাইয়্যাহ বা কওমী প্রাথমিক মাদ্রাসা।

দ্বিতীয় স্তর : ধরা হয় ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির মান। আরবি ভাষা, বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ফিকাহশাস্ত্র, ও সমাজ বিজ্ঞান পড়ানো হয় এ স্তরে। এটাকে বলে আল মারহালাতুল মুতাওয়াসসিতাহ এর মেয়াদ ৩ বছর।

 

·       ·  দ্বিতীয় পর্যায় : এপর্যায়ে শ্রেণিগুলোকে ৪টি স্তরে ভাগ করা হয়েছে

১ম স্তর : আল মারহালাতুস সানাবিয়্যাহ (মাধ্যমিক স্তর), ২ বছর মেয়াদ (৯ম - ১০ম)

২য় স্তর : আল মারহালাতুস সানাবিয়্যাতুল উলইয়া (উচ্চ মাধ্যমিক স্তর), ২ বছর মেয়াদ (একাদশ-দ্বাদশ)

৩য় স্তর : আল মারহালাতুল ফজিলত (স্নাতক ডিগ্রি) ২ বছর মেয়াদ

৪র্থ স্তর : আল মারহালাতুল তাকমিল (মাস্টার্স ডিগ্রি) ২ বছর মেয়াদ এ স্তরকে দাওরায়ে হাদিস বলা হয়।

 ·    তৃতীয় পর্যায় : এ স্তরে উচ্চশিক্ষা বা বিষয়ভিত্তিক ডিপ্লোমা ও গবেষণামূলক শিক্ষা কোর্স। হাদিস, ফিকহ, ফতওয়া, তাজবিদ, তাফসির, বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি, ইসলামের ইতিহাস, সীরাত, ইলমুল কালাম, উর্দু ও ফারসি ভাষা, আরবি সাহিত্য, ইসলামি দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পৌর বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণামূলক শিক্ষা।

 ·    নূরানী ও হাফেজিয়া মাদরাসা : যেসকল শিক্ষার্থীরা কুরআনের হাফেজ (যারা সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত করে) হতে চায় বা কুরআন বিশুদ্ধভাবে পড়া শিখতে চায়, তাদের জন্য নূরানী ও হাফেজিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে আমাদের দেশে হাজার হাজার নূরানী ও হাফেজিয়া মাদরাসা আছে এবং লক্ষ লক্ষ ছাত্র আছে যারা এইসকল প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে

 

. কারিগরি শিক্ষা

যে শিক্ষায় শিক্ষার্থী তার বাস্তব জীবনে ব্যবহার করে কোন একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিযুক্ত হতে পারে তাই কারিগরি শিক্ষা। ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ সরকার দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টির লক্ষে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন এই প্রতিষ্ঠানটি কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের একটি অধিদপ্তর। এই শাখার মূল কাজ চারটি : মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা, একাডেমিক কার্যক্রমের তদারকীকরণ, উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা, এবং কারিগরি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করা।

 

এই দপ্তরের অধীনে মোট ১৬৯টি প্র্রতিষ্ঠান আছে। সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ও ডিগ্রী এই তিনটি স্তরে পাঠদান পরিচালিত হয়। ডিপ্লোমা পর্যায় ৪৯টি পলিটেকনিক ইন্সটিটউট এবং ডিগ্রী পর্যায় টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ-১টি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-৪টি রয়েছে সার্টিফিকেট পর্যায়ে রয়েছে ১১৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ।  ১টি ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট। এই প্রতিষ্ঠানের সদরদপ্তর এফ-৪/বি, শেরে-ই-বাংলা নগর প্রশাসনিক এলাকা, আগারগাঁও, ঢাকা-১২০৭ এ


উপসংহার : আপনি যদি ইচ্ছে করেন দেশের যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোনোটিকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। শিক্ষিত সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষা গ্রহণ থেকে পিছিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই।তাই আসুন আমাদের দেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে আমরা সবাই শিক্ষিত হই।

আপনার যদি এই লেখাটি পছন্দ হয় বা এই লেখাটি পড়ে ভালো লাগে অথবা কোনো পরামর্শ থাকে তাহলে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন। আমাদের পরবর্তী লেখাটি পড়ার বিনীত অনুরোধ রইল  

Post a Comment

0 Comments